
২০২৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল প্রায় স্থবির। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের কাছে তখন ইসলামাবাদকে মনে হতো তালেবান-ঘেঁষা, রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও কৌশলগতভাবে অনিশ্চিত একটি রাষ্ট্র। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বন্যা-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের পরও পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল বহির্ভরশীল এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ছিল গভীর সন্দেহ।
মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘদিন ধরে অস্বচ্ছ, দ্বিমুখী কৌশলের অনুসারী এবং সন্ত্রাসবিরোধী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অনাগ্রহী বলে বিবেচনা করা হতো। এমনকি বিভিন্ন বিশ্লেষণে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, দেশটি আগামী এক দশকে গুরুতর নিরাপত্তা সংকটে পড়তে পারে।
তবে বছরের শেষভাগে এসে দৃশ্যপট বদলে যায় নাটকীয়ভাবে। কয়েক মাসের ব্যবধানে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অবহেলিত অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে রূপ নেয়। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে এখন পাকিস্তান একটি কেন্দ্রীয় জায়গা দখল করেছে।
ভারতের ওপর নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন
ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুতে নীতিনির্ধারকদের মূল মনোযোগ ছিল ভারতের দিকে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কোয়াড জোট জোরদার এবং চীনের প্রভাব মোকাবিলায় নয়াদিল্লিকে প্রধান অংশীদার হিসেবে দেখা হচ্ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তখন ওয়াশিংটনের সন্দেহ আরও বাড়িয়েছিল।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপথ, নাগরিক অধিকার নিয়ে সমালোচনা, সামরিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং কূটনৈতিক অনমনীয়তা মার্কিন মহলে নতুন করে ভাবনার জন্ম দেয়। ভারত আদৌ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ কি না এই প্রশ্ন ধীরে ধীরে গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মোড় ঘোরে নীরব সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার মাধ্যমে। কয়েক দফা গোপন যোগাযোগে ইসলামাবাদের বাস্তব সহযোগিতার আগ্রহ ওয়াশিংটনের নজর কাড়ে। মার্চ মাসে এক জাতীয় ভাষণে হঠাৎ করেই পাকিস্তানের ভূমিকার প্রশংসা করেন ট্রাম্প, যা দীর্ঘদিনের মার্কিন অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।
এই বক্তব্যের পর থেকেই পাকিস্তানকে ঘিরে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইসলামাবাদও সুযোগটি কাজে লাগাতে পিছপা হয়নি। ছোট ছোট সহযোগিতামূলক উদ্যোগ দ্রুতই বড় কূটনৈতিক লাভে রূপ নিতে থাকে।
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ ও মোড় পরিবর্তন
মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বল্পস্থায়ী কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘর্ষ এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে। পাকিস্তানের সামরিক শৃঙ্খলা, কৌশলগত প্রস্তুতি ও সক্ষমতা মার্কিন প্রশাসনের জন্য ছিল
অপ্রত্যাশিত। এতদিন যাকে ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেই পাকিস্তান আবার আঞ্চলিক খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে।
এই অভিজ্ঞতার পর দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত মানচিত্র ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে নতুনভাবে আঁকা হয়, যেখানে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়।
সামরিক সংস্কার ও নতুন নেতৃত্ব
এই নতুন গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আসে। কমান্ড ব্যবস্থার পুনর্গঠনের মাধ্যমে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ নামে নতুন শীর্ষ পদ সৃষ্টি করা হয়। এই দায়িত্ব পান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির, যিনি একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
ভারত যেখানে যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ট্রাম্পের মধ্যস্থতাকে গুরুত্ব দেয়নি, সেখানে পাকিস্তান প্রকাশ্য কৃতজ্ঞতা জানায়। এই পার্থক্য ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের অবস্থান আরও শক্ত করে।
ওয়াশিংটনে আসিম মুনিরের উত্থান
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলে দ্রুত পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন আসিম মুনির। দুই নেতার ব্যক্তিগত যোগাযোগকে উপদেষ্টারা অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ বলেই উল্লেখ করছেন। পাকিস্তানের কোনো সামরিক প্রধান হিসেবে এই প্রথম হোয়াইট হাউসে আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ পান মুনির।
এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি আবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং সেন্ট্রাল কমান্ড সদরদপ্তরে শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন, যা পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয়।
নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
২০২৬ সালের শুরুতে এসে পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য-কেন্দ্রিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইরান, গাজা পরিস্থিতি ও চীনের আঞ্চলিক প্রভাব মোকাবিলায় পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে একাধিক কৌশলগত সুযোগ দিচ্ছে।
এক বছরের ব্যবধানে যে সম্পর্ক ছিল দ্বিধাগ্রস্ত ও সীমিত, তা এখন কৌশলগত আলোচনার কেন্দ্রে। ওয়াশিংটনে আপাতত ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ ধারণা পেছনে পড়েছে। পাকিস্তানের এই রূপান্তর এখনও চলমান, তবে এর প্রভাব ইতোমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে স্পষ্ট পরিবর্তন আনছে।