
বাংলাদেশ ও তুরস্ককে প্রায়শই নতুন অংশীদার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, যাদের সম্পর্ক আধুনিক কূটনীতির বাইরেও বিস্তৃত। তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল, যার প্রতিফলন দেখা যায় কাজী নজরুল ইসলামের ১৯২১ সালের কবিতা ‘কামাল পাশা’-তে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নামে সড়ক নামকরণসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগ প্রমাণ করে যে এই সম্পর্ক কেবল লেনদেন-নির্ভর নয়; এটি মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরোধের মতো যৌথ মূল্যবোধে গড়ে ওঠা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকা-ইস্তাম্বুল আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বিকশিত হয়। ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, ১৯৭৬ সালে ঢাকায় দূতাবাস খোলে এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আঙ্কারায় দূতাবাস স্থাপন করে। সম্পর্কটি টানাপোড়েনে পড়ে যখন ২০১৩ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। তবে ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পর সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়, যখন তুরস্ক কূটনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি মানবিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে।
কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অবস্থান, তীব্রতর আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ বহুমুখী নিরাপত্তা অংশীদারিত্বকে অপরিহার্য করে তুলেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে সীমিত কয়েকটি দেশের ওপর প্রতিরক্ষা সরঞ্জামে নির্ভরতা ঝুঁকি তৈরি করেছে। এই ক্ষেত্রে, একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষা উৎপাদনকারী হিসেবে তুরস্কের উত্থান বাংলাদেশকে ঝুঁকি কমানোর সুযোগ করে দিতে পারে, যদি সহযোগিতাটি স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা সম্ভাবনার তুলনায় এখনও সীমিত। বাংলাদেশের তরুণ শ্রমশক্তি ও আঞ্চলিক বাজারে প্রবেশাধিকার এবং তুরস্কের উৎপাদন দক্ষতা ও মধ্যম মানের প্রযুক্তি একত্র হলে যৌথ উৎপাদন ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হতে পারে। শরণার্থী রাজনীতিতেও উভয় দেশের অভিজ্ঞতায় মিল রয়েছে সিরীয় শরণার্থী ও রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক দায়িত্ব ভাগাভাগির প্রশ্নে তাদের যৌথ নৈতিক অবস্থান শক্তভাবে তুলে ধরে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেল বন্ধন এই অংশীদারিত্বকে আরও দৃঢ় করছে। তুর্কি নাটক, শিক্ষাবৃত্তি, শিক্ষা-বিনিময় ও সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া এমন একটি সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করেছে যা প্রায়শই রাজনৈতিক চক্রের বাইরেও সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে। তাই ভারত বা চীনের বিপরীতে বাংলাদেশ-তুরস্ক সম্পর্ককে দাঁড় করানো বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশের প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত স্বার্থে ভিন্ন অংশীদার। দেশের ২০২৬ সালের নির্বাচন ও ঢাকায় সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকরণ।
যদি তুরস্কের সাথে সম্পর্ককে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সম্পর্কটি ভঙ্গুর হয়ে উঠতে পারে। টেকসই ও বাস্তবসম্মত অংশীদারিত্বের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, যাতে সরকার বদলালেও কর্মসংস্থান, শিক্ষা, ন্যায্য বাণিজ্য, মানবিক সহযোগিতা ও জবাবদিহিমূলক প্রতিরক্ষা সম্পর্ক অব্যাহত থাকে।





