
মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ’..। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই পংক্তির মতোই কিছু কিছু মৃত্যুতে সত্যি দুঃখ কোন নেই, সে মৃত্যু বড় মহীয়ান, কোটি প্রাণের মাঝে অমর হয়ে থাকা। বিপ্লবী বীর জুলাই যোদ্ধা শহীদ ওসমান হাদি এদেশের মানুষের প্রাণে তেমনি ছড়িয়ে গেছেন। লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি চির বিদায় নিয়েছেন। গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হয়েছে। এ সময় তার সহকর্মীরা অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। শপথ নেন হাদির স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রাখবেন। তারা বলেন, লাখো মানুষের ভালোবাসা প্রমাণ করে জীবিত হাদির চেয়ে শহীদ হাদি অনেক শক্তিশালী।
বিকেল ৩টায় হাদির লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবরস্থানে পৌঁছায়। কবরস্থানের আশপাশে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং শাহবাগ মোড় থেকে কবরস্থানে প্রবেশের সড়কে জনসাধারণের প্রবেশ তখন সীমিত করা হয়।
এ সময়, শহীদ হাদির পরিবারের লোকজন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নিয়াজ আহমেদ খান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও অন্যান্য নেতারা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, ডাকসু নেতারা এবং ইনকিলাব মঞ্চের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় শরিফ ওসমান হাদির জানাজা শুরু হয়। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জানাজা পড়ান শহীদ হাদির বড় ভাই ড. মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক। জানাজায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়েরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। জানাজাপূর্ব বক্তব্য রাখেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব জাবের এবং ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন শহীদ হাদির জীবনী পাঠ করেন।
জানাজায় অংশ নিয়ে প্রধান উদেষ্টা বলেন, প্রিয় ওসমান হাদি আজ আমরা তোমাকে বিদায় দিতে আসিনি। তোমার কাছে ওয়াদা করতে এসেছি, তুমি যা বলে গেছো, সেটা যেন পূরণ করতে পারি। শুধু আমরা নয়, বংশানুক্রমে দেশের সব মানুষ পূরণ করবে। তোমার মানবপ্রেম, ভঙ্গি মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সবাই গ্রহণ করেছে।
জানাজার আগে শরিফ ওসমান হাদির বড় ভাই ও জানাজার ইমাম ড. মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিক ভাই হত্যার বিচার চান। তিনি বলেন, ৭-৮ দিন হয়ে গেলো, খুনি দিবালোকের মধ্যে গুলি করে যদি পার পেয়ে যায় এর চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। যদি বর্ডার ক্রস হয়ে যায়, ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে তারা কেমন করে গেলো? এই প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমার ভাই শহীদ হয়েছে, তার শহীদী তামান্না ছিল। হয়তো আল্লাহ তার শহীদী মৃত্যু নসিব করেছেন। কিন্তু আপনাদের কাছে আমি এই ঋণ কখনো ছাড়বো না, আমার ভাই শরিফ ওসমান হাদির বিচার যেন প্রকাশ্যে এই বাংলার জমিনে দেখতে পারি।
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, তারা ওসমান হাদিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল; আর তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীকে। তিনি বলেন, দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে শাহাদতের মর্যাদা দান করেন এবং তার জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি আল্লাহ তায়ালা মার্জনা করেন। আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের টুকরা বানিয়ে দেন। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- আধিপত্যবিরোধী একটি ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন- তার সেই স্বপ্ন পূর্ণতা দেয়ার জন্য দেশবাসীকে তৌফিক দান করুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, শহীদ শরিফ ওসমান হাদি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। দেশের জন্য তার যে ত্যাগ আল্লাহ তা কবুল করুক। তার পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারিত পরিবারের অংশ। আমরা তার চূড়ান্তভাবে সম্মান জানাতে আমাদের এ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে কবরস্থ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সন্তানকে বুকে নিয়েছে। মা তার ছেলেকে বা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে গ্রহণ করেছে।
গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করে দুর্বৃত্তরা। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ ডিসেম্বর শহীদ হন ওসমান হাদি।