ফ্যাসিস্টের ৫৬,১৮৭ দোসর গ্রেপ্তার, ৭০ ভাগই জামিনে মুক্ত

আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে।

জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর চালানো সহিংসতা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়

পাশাপাশি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, নাশকতাউসকানির অভিযোগেও মামলা দায়ের করা হয়। তবে গ্রেফতারের কয়েক মাস না পেরোতেই এসব মামলার অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে যান।

পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী হিসেবে দেশজুড়ে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই বর্তমানে জামিনে বাইরে রয়েছেন

জেলা পর্যায়ে এই হার কোথাও কোথাও ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।

রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে যারা দীর্ঘদিন ধরে হত্যা, নিপীড়ন ও সহিংসতায় যুক্ত ছিল, তাদের এমন সহজ মুক্তি জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের মধ্যে গভীর শঙ্কার জন্ম দিয়েছে

প্রসিকিউশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে- আদালতে জামিন ঠেকাতে তারা আদৌ কার্যকর ভূমিকা রাখছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে।

এরই মধ্যে জুলাই যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর হত্যাচেষ্টার ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে

খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, হামলাকারী ফয়সাল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

গত বছরের অক্টোবরে একটি ডাকাতির ঘটনায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হলেও মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সে জামিন পায়

অনেকের মতে, সে সময় জামিন না পেলে হাদির ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটত না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, ফয়সালের মতো আরও বহু দোসর জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপনে থেকে নানামুখী ষড়যন্ত্রে জড়িত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে

বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাসহ পলাতক নেতাদের নির্দেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে এই চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, প্রসিকিউশন প্রতিটি মামলাতেই জামিনের বিরোধিতা করে।

তবে শেষ সিদ্ধান্ত আদালতের ওপর নির্ভরশীল। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বয়স, অসুস্থতা, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন, তদবির ও রাজনৈতিক পরিচয়ের মতো বিষয় অনেক সময় জামিনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।

কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা ও আসামির মধ্যে সমঝোতার অভিযোগও রয়েছে, যা জামিন সহজ করে দেয়।

একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন পা হারানো জুলাই যোদ্ধা আব্দুল্লাহ আহমাদ। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা যেভাবে একের পর এক জামিন পাচ্ছে, তা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

এর পেছনে যারা কাজ করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি

সূত্র আরও জানায়, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর অনেক দোসর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনে ঢুকে পড়ছে, এমনকি জুলাই যোদ্ধাদের কিছু প্ল্যাটফর্মেও অনুপ্রবেশের অভিযোগ রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ৫৬ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হলেও প্রায় ৩৯ হাজারই ইতোমধ্যে জামিন পেয়েছে। বিভিন্ন জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় জামিনের হার কোথাও ৯০ শতাংশেরও বেশি।

পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রেফতার হওয়া আসামিরা কীভাবে এত দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আবার সংগঠিত হচ্ছে, তা আমাদের কাছেও প্রশ্নের বিষয়।

রাজনৈতিক চাপ, ভোটের হিসাব এবং অর্থনৈতিক লেনদেন-সব মিলিয়েই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

একজন অতিরিক্ত আইজি মন্তব্য করেন, ফ্যাসিবাদের দোসরদের রাজনৈতিক দলে টেনে নেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

তার মতে, জামিনে মুক্ত হয়ে কেউ কেউ নতুন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে ভেতর থেকে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে, যা সাম্প্রতিক হামলাগুলোর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে

ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী জানান, পুলিশের দায়িত্ব আসামি গ্রেফতার ও আদালতে জামিনের বিরোধিতা করা। আদালত জামিন দিলে পুলিশের করার তেমন কিছু থাকে না।

তবে জামিনপ্রাপ্ত অনেককেই নজরদারিতে রাখা হচ্ছে এবং তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মেট্রোপলিটনরেঞ্জ পর্যায়ে জামিনের হার ৫০ থেকে ৯০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে জামিনপ্রাপ্ত দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে- এমন গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেছে।

সে অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।