অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আগের সরকারের ভুল নীতির রেশ কাটেনি এখনো। ডলারপ্রবাহ সামান্য বাড়লেও সংকট আছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় অব্যাহতভাবে বাড়ছে সুদের হার। ফলে উচ্চ সুদের হারে বিনিয়োগ স্থবিরতা প্রকট হচ্ছে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতা, শিল্পাঞ্চলে টানা অস্থিরতা, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ। মানুষ বদল হয়েছে ঠিকই; কিন্তু আগের মতো জেঁকে বসেছে চাঁদাবাজিও। নানা অজুহাতে দাবিদাওয়ার আড়ালে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলা, নিরপরাধ ব্যবসায়ীদের হয়রানিমূলক মামলাসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা মহলে আস্থাহীনতা, শঙ্কা, ভয় আর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। থমকে আছে ব্যবসার প্রসার ও নতুন বিনিয়োগ।
আছে ভাবমূর্তির সংকটও। এ কারণে দুই মাস ধরে পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে আসছেন না। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে রপ্তানিমুখী শিল্প, মানুষের কর্মসংস্থান ও সরকারের রাজস্ব আয়। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা যায়, আগের সরকারের অব্যাহত ভুল নীতিতে এমনিতেই দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ, শিল্পের প্রসার ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিস্থিতি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এরপর ওই সরকার পতন হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। বিভিন্ন মহল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দাবিদাওয়া চেয়ে চাপ তৈরি করা হয়। অতি উৎসাহী একটি চক্র ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা করে। নির্বিচারে মামলা-হামলা দেওয়া হয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীকে।
দাবিদাওয়া মানার পরও পোশাকশিল্পে লাগাতার বিক্ষোভ, ধর্মঘট চলতে থাকে। এতে বিদেশে পোশাকের ক্রেতাদের কাছে ভুল বার্তা যায়। নিরাপত্তা ইস্যুতে তাঁরা বাংলাদেশে আসা বন্ধ রেখেছেন।
একদিকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চলছে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু সাহসী সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। লেনদেনে কড়াকড়ি ও কিছু দিন এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। তবে এতে অপপ্রচারের ফলে কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হন গ্রাহকরা। এ আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানো হয় কয়েক দফা। সম্প্রতি আরেক দফা বাড়ানো হয় সুদের হার।
এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যায়। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকির পাশাপাশি ব্যবসা প্রসারেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায় স্লথগতির কারণে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের ব্যবসা চালাতে কষ্ট হচ্ছে। নতুন কাজের সুযোগ হচ্ছে না। উল্টো অনেকের চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-উদ্যোগে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ব্যাংকঋণের সুদহার দফায় দফায় বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রায় আড়াই বছর ধরে অব্যাহত সংকটের কারণে ডলারের দর বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ। এতে আমদানি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ফলে শিল্পে উৎপাদন সংকুচিত হয়েছে। পরিবহন খরচ বেড়েছে। ফলে ব্যয়বহুল হয়েছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিভিন্ন রেগুলেটরি সংস্থার ভুলনীতি এবং সময়-অসময়ে দেওয়া বিভিন্ন সার্কুলার অনেক উদ্যোক্তাকে ঋণখেলাপিতে পরিণত করেছে। তাই স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি নয়; বরং সরকারের নীতিমালার জন্য খেলাপি হয়েছেন—এমন উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার দাবি উঠেছে। অন্যথায় সামনে দেশের কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতিতে স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হবে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
ব্যবসায়ীদের অনেকে মনে করেন, যাঁরা স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হয়েছেন, তাঁরা চিহ্নিত। দেশের সবাই জানে, কারা হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংকিং নীতিমালা মানেনি। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে দ্রুত এসব টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
তবে যেসব ভালো ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুলনীতি, ডলারসংকট, কভিড-পরবর্তী সংকট এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি, একই সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা এবং নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের টিকে থাকার জন্য নীতি সহায়তা এবং টিকে থাকতে না পারলে ব্যবসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার নীতি সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী ডলারসংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি করতে পারেননি। ফলে সময়মতো পণ্য উৎপাদন করতে না পারায় ক্রেতাদের হ্রাসকৃত মূল্যে পণ্য দিতে হয়েছে। সময়মতো জাহাজীকরণ করতে না পারায় ক্রেতারা পণ্য নেয়নি। এসব ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না।
তাঁদের অনেককে বিদ্যমান উচ্চ পরিবহন খরচ, সরকারের দপ্তরগুলোতে সেবার বিপরীতে অনৈতিক সুবিধা দিতে গিয়ে সংকটে পড়তে হয়েছে। ফলে অনেক ভালো উদ্যোক্তারা সময়মতো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। যাঁরা প্রকৃত কারণে খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের ঋণ পরিশোধ করাসহ ঋণ পুনঃ তফসিল করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বৈশ্বিক যুদ্ধ আর করোনা মহামারির পর পুরো বিশ্বে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। কারণ একটি কম্পানি খারাপ হলে পুরো গ্রুপের সিআইবি রিপোর্ট খারাপ দেখানো হচ্ছে। এর মানে করোনাকালের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।’